চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিককার ঘটনা। জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলা শেষ পর্যায়ে। যেকোনো দিন রায় ঘোষণা হতে পারে। দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে, রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া দণ্ডিত হতে যাচ্ছেন-এমন কথাবার্তা চলছে। এমন সময়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের ডেকে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করলেন বেগম জিয়া। গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা বাতিল করা হলো। বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা ছিল, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তাঁরা হলেন: (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি। ‘
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে. এম. নুরুল হুদার কাছে সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেয়।
কোনো দলকে নির্বাচন কমিশনের কিছু শর্ত পূরণ করে নিবন্ধন করতে হয়। আর এই শর্তের অন্যতম একটি হলো, কোনো দলের গঠনতন্ত্র অবশ্যই দেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। আর এই কারণেই জামাতের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাতিল হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামটির নিবন্ধনও বাতিল হয়েছে। নিবন্ধনের একটি শর্তে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যারা সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন করাই নয়। এই কমিশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি আছে, যারা রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়েও খোঁজ খবর রাখে। ওই কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন পর্যালোচনা করে, দলগুলোর আয়-ব্যয় হিসেবও রাখে। এই গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠিত হয়েছে ওয়ান ইলেভেনের বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। রাজনৈতিক দলগুলো যেন স্বেচ্ছাচারী না হতে পারে সে কারণেই এমন কমিটি। বিতর্কিত সময়ে গঠিত হলেও এমন কমিটিকে সাধুবাদ জানান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোও জবাবদিহিতার মধ্যে আসে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে জমা দেওয়া বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র উল্লিখিত ওই কমিটিতে যায়। পরে একজন নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের এক নিরীক্ষা কমিটি বিএনপির গঠনতন্ত্র ও এর সংশোধন খতিয়ে দেখে। নিরীক্ষা কমিটি মতে, বিএনপির গঠনতন্ত্রে যে সংশোধন করা হয়েছে তা সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) ‘ঘ’ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) ‘ঘ’ এ বলা হয়েছে, ‘(২) কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি
(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অনূন্য দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে;’
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো সংশোধন গৃহীত হবে না। নির্বাচন কমিশনের সংবিধান নিরীক্ষা কমিটির মতে, তারেক জিয়াকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার বিষয়টি দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জিয়া অরফানেজ দুর্নীতি মামলার রায়ে বেগম জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ওই রায়ের দিনই বেগম জিয়াকে পুরান ঢাকার পুরোনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। একই মামলায় বেগম জিয়ার ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়াসহ পাঁচজনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে বেগম জিয়া কারাগারে গেলেও তারেক জিয়া লন্ডনে পালিয়ে আছেন। আর বেগম জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পর বিএনপি মসনদে বসেছেন তারেক জিয়া, হয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এর আগেও তারেক জিয়া অপর এক মামলায় ৭ বছরের জন্য দণ্ডিত হলেও কারাগারে যাননি। আবার ওই মামলায় আপিলের সময় শেষ হয়ে গেলেও আদালতে কোনো আপিল আবেদন করেননি তারেক জিয়া।
নির্বাচন কমিশন বলছেন, নৈতিক স্থলনগত কারণে তারেক জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ায় তারেক জিয়া কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানও হতে পারেন না।
জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্বাচন কমিশনে এই বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়টি আগামী সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার বা সোমবার বিএনপি জানানো হবে।
নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিএনপি যদি অবিলম্বে তারেক জিয়াকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ থেকে না সরায় তাহলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিলও হতে পারে।